ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি ও কিভাবে কাজ করে এবং এর ব্যবহার

  



 (Virtual reality) ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি:-

প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের চেতনা উদ্রেককারী বিজ্ঞান নির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা অনুভবে বাস্তবতা কিংবা কল্পবাস্তবতা বলা হয়। এ কে সংক্ষেপে VR বলা হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মূলত কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সিমুলেশন তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। এতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Vizard, VRTooIk, 3d studio Max, Maya ইত্যাদি। ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ত্রিমাত্রিক ইমেজ তৈরীর মাধ্যমে প্রতি অসম্ভব কাজও করা সম্ভব হয়। কল্পনার পাখায় ভর করে ইচ্ছা করলে চাঁদের মাটিতে হেঁটে আসা যায়, প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম অঞ্চলে ঘুরে আসা যায়, মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন সংযোগের উপর দিয়ে হাঁটা কিংবা জুরাসিক পার্ক অতিকায় ডাইনোসরের তারাও খাওয়া যায়। 




ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ যেখানে ব্যবহারকারী ওই পরিবেশে মগ্ন হতে, বাস্তবের অনুকরণে সৃষ্ট দৃশ্য উপভোগ করতে, সেইসাথে বাস্তবের নেই শ্রবন অনুভূতি এবং দৈহিক ও মানসিক ভাবাবেগ, উত্তেজনা অনুভূতি প্রভৃতির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। 




ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উদাহরণ:-

নামকরা একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক মোঃ মমিনুর রহমান চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে পড়াচ্ছেন। তিনি মুখে সুন্দরভাবে বুঝাতে চাচ্ছেন কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আকর্ষিত করে মনোযোগী করতে পারছেন না। 10 মিনিট পর মোঃ মমিনুর রহমান স্টুডেন্ট দের কে নিয়ে কম্পিউটার ল্যাবে আসলেন। ল্যাব এসিস্ট্যান্ট সবাইকে মাথায়  হেলমেট এবং হাতে বিশেষ গ্লাভস ও পায়ের যন্ত্রপাতিসজ্জিত জুতো পরিয়ে দিলেন। ছাত্ররা প্রত্যেকে দেখল তারা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে এসেছে। সামনে বিশাল সমুদ্র। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে পড়ছে তীরে, সমুদ্রের গর্জন করছে, বাতাস বইছে, পেছনে পাখির শব্দ করে, কেউ কেউ সমুদ্রের পানির দিকে এগুলো, আস্তে আস্তে পানিতে নেমে পড়লো। কেউ কেউ পায়ে পানির ঠাণ্ডা অনুভূতি পাচ্ছে।  কেউ নিচু হয়ে হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করলে ঠান্ডা পানির স্পর্শ অনুভব করল। 



কেউ কেউ সমুদ্রের তীরে তীর দিয়ে কিছুক্ষন হাটলো। তারা এই তো কিছুক্ষণ আগে তারা যা পড়ৃল এখন বাস্তবে ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে। সবাই তা অনুভব করছে। এভাবে 15 মিনিটের মতো তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত বিচরণ করে আসলো। বাস্তবে অনেক কিছু দেখতে থাকলো এক সময় সবকিছু অন্ধকার। কম্পিউটার ল্যাব সহকারী তাদের সবার হেলমেট খুলে নিলেন। তন্ময় হয়ে সবাই কিছুক্ষণ বসে থাকল এবং চিন্তা করল তারা স্বপ্ন দেখছে নাতো?  মনোযোগী ছাত্র ছাত্রীরা এই রকম তন্ময় হয়ে বসে আছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই  মোঃ মমিনুর রহমান মুচকি হাসিতে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রশ্ন করলো?  কি তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?  সবাই সমস্বরে উত্তর দিলো কক্সবাজার স্যার। আর এটাই হল ভার্চুয়াল রিয়েলিটি।



ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরির উপাদান সমূহ:-

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কে তৈরি করার জন্য হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে, একটি পূর্ণাঙ্গ বডি স্যুইট, উচ্চমানের অডিও ব্যবস্থা, রিয়েলিটি ইঞ্জিন, বিভিন্ন রকম সেন্সর, বিভিন্ন সিমুলেশন ও সফট্ওয়ারে ইত্যাদির দরকার হয়। এছাড়াও স্পেক্টর, রিয়েলিটি- সিমুলেশন, অ্যাপ্লিকেশন ও জিওমেট্রির  প্রয়োজন হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি একজন ব্যক্তি কে কোন রকম শারীরিক ঝুঁকি বা বিপদ ছাড়াই বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রদান করে। সম্প্রতি গুগল Lively নামে ভার্চুয়াল চ্যাটিং সার্ভিস চালু করেছে। যেখানে ভার্চুয়াল কক্ষ বা পরিবেশে মে কেউ তার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে প্রবেশ করতে পারে। সেখানেত ইচ্ছে মতো  বস্তু দিয়ে সাজানো, বন্ধুদের সাথে মারামারি, নাচানাচি, আবেগের গ্রাফিক্যাল প্রকাশ ইত্যাদি সম্ভব।




বাংলাদেশি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি:-

দেশের মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান মনস্ক করে গড়ে তোলা এবং বিনোদনের মাধ্যমে মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্র সম্পর্কে ধারণা প্রদানের লক্ষ্যে  1995 সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং 2004 সালে থেকে দর্শকদের জন্য চালু করা হয়। ঢাকা শহরের বিজয় সারণিতে অবস্থিত একটি স্থাপনা এটি। 




এখানে নভোমন্ডল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এবং নভোমন্ডলের ধারণা পাওয়ার জন্য কৃত্রিম নভোমন্ডল তৈরি করা , হয়েছে। নভোথিয়েটারে অ্যাক্রোবেটিক এরোপ্লেন, রেসিং কার, স্ক্রাপ এয়ারক্রাফট, ফাইবার এবং প্রাচীন পিরামিডের কোস্টা্রে চড়ে ভ্রমণের জন্য আনুভূমিক ও উলম্বভাবে গতিবিশিষ্ট ফ্লাইট সিমুলেটর রয়েছে। এখানে প্রদর্শিত মহাকাশ বিষয়ক ফ্লিম জার্নি টু ইনফিনিটি দেখল মনে হবে বাস্তবের মহাকাশে ভ্রমণ করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পার্কে নভোযান অথবা সিমুলেটর রয়েছে যেগুলোতে বাস্তবের ন্যায় ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। বাংলাদেশ বাংলাদেশ  মহিলা পুলিশকে কার ড্রাইভিং শেখানোর জন্য কার সিমুলেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। 




প্রত্যাহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রভাব:-

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের জন্য ও পেশাজীবীদের বাস্তবসম্মত ও নিরাপদ প্রশিক্ষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে চিকিৎসা, গাড়ি বা বিমানচালনা, সামরিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রগুলোতে, বিভিন্ন শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে সেগুলো সহজে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাপদ করে তোলা সম্ভব। এভাবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শিক্ষা বিনোদন সহ দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রয়োজনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যার মধ্যে প্রধান প্রধান ক্ষেত্র গুলো নিয়ে নিয় বিষয়টি পর্যালোচনা করা হলো:-




১) চিকিৎসা ও ডাক্তার প্রশিক্ষণ

উন্নত বিশ্বের ডাক্তারদের আধুনিক মানের প্রশিক্ষণ প্রদান এই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সার্জিক্যাল প্রশিক্ষণে প্রদান করা হচ্ছে। জটিল সব অপরেশন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলোর গঠন ও কার্য পর্যালোচনা, ডিএনএ পর্যালোচনা প্রভৃতি সম্পর্কে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যাপকভাবে জানা ও গবেষণা চালানো সম্ভব। মনোবিশেষজ্ঞগণ  মানসিক রোগীদের সাইকোথেরাপি দিতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করেন যার ফলে মানসিক রোগীদের জীবন দর্শনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। 




২) কার ও  বিমান প্রশিক্ষণ 

বর্তমান  কার  ড্রাইভিং এর নানা নিয়মকানুন খুব সহজেই আয়ত্ত্ব করা সম্ভব ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে বাস্তবের মতো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে প্রশিক্ষণার্থী খুব সহজেই বাস্তবে গাড়ি চালানোর সাহস অর্জন করে। উন্নত বিশ্বের বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা কিংবা সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বিমান পরিচালনা প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করছে। ফ্লাইট সিমুলেশন হল এমন একটি পদ্ধতি যেখানে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কে কাজে লাগিয়ে বিশেষায়িত কম্পিউটার সিস্টেম সমূহ যেমন ফ্লাইট সিমুলেটর সমূহের মাধ্যমে সিভিলিয়ন কিংবা মিলিটারি পাইলটদের সত্তিকারের এয়ারক্রাফট ছাড়াই সেটি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।




৩) এছাড়াও আরো নানা ধরনের ক্ষেত্রে:-

আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার করে থাকি যেমন- ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়, সেনাবাহিনীর যুদ্ধ প্রশিক্ষণে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। মহাশূন্য অভিযানে, গেমস তৈরি করার ক্ষেত্রে (Xbox one x, PS4 এবং কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমস রয়েছে), প্রকৌশলী ও নগর উন্নয়নে, শিল্প-কারখানায়, খেলাধুলা ও শরীরচর্চায়, বিনোদন ও মিডিয়া ক্ষেত্রে, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় পানির ব্যবহার করা হয়। 




ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক প্রভাব:-


১) চড়া দাম এবং জটিলতা

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সরঞ্জামাদির দাম অনেক চড়া  হওয়ায় কারণে সাধারণের মধ্যে এর প্রসার এবং জটিলতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্নতায় আছেন। অনেক সময়ই এর হ্যান্ডসেটের গতি ব্যবহারকারীর স্বাভাবিক গতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারেনা। 




২) স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মাইসোর রিলিটি এর ব্যবহার মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এটি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি ক্ষতিসাধন করে।



৩) কল্পনার জগতে বিচরণ

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে ইতিমধ্যে বিচরণ করতে পারেন। অনেক সময় ধরে কল্পনার জগতে থাকলে বাস্তবতা থেকে মানুষ আস্তে আস্তে দূরে সরে যাবে ফলে পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসবে।



৪) মনুষ্যত্বহীনতা 

ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে মানুষ বাস্তবিক এরচয়ে ভালো পরিবেশ ও মনের মতো সঙ্গী পাবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যাপক প্রসারের কারণে মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়ার হ্রাস  পাবে এবং মনুষত্বহীন এত বেড়ে যাবে। ফলে ক্রমেই মানবসমাজ বিলুপ্ত হতে থাকবে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ